দমনে নানা কার্যক্রম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘মাথাব্যথা’র কারণ কিশোর গ্যাং

ভোলার কথা
নিজস্ব প্রতিবেদক সম্পাদক
প্রকাশিত: ১০:১১ পূর্বাহ্ণ, মে ১৬, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথাব্যথার অন্যতম বড় কারণ কিশোর গ্যাং। খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মারামারি, মাদকসেবন, ভূমি দখল, ইভটিজিংসহ নিত্যনতুন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়মিত ঘটিয়ে যাচ্ছে তারা। আর এসব বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অত্যাচারে স্থানীয় লোকজন অতিষ্ঠ ও অসহায় হয়ে পড়েছে।

অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা প্রতিপক্ষকে হেনস্থা করতে টাকা, ড্রাগসসহ বিভিন্ন প্রলোভনে কিশোরদের ব্যবহার করে থাকে। এত করে কিশোররা যখন দেখে এই কাজ থেকে প্রতি মাসে সহজেই ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করা যায়, তখন তারা এই পথ থেকে বের হতে পারে না। আর পুলিশ জানায়, এসব গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক যেই হোক না কেন, পুরোপুরি নির্মূলে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গত দুই বছরে ৩৪ জন কিশোর নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় গত বছর ২৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, নারীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ প্রভৃতি ঘটনা। এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় খুব নৃশংসভাবে। ছুরিকাঘাত করার পর ইট ও লাঠি দিয়ে মেরে পুরো শরীর, মুখ, মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মৃত্যুর পর লাশ গুমের উদ্দেশ্যে খণ্ডবিখণ্ড করার মতো নৃশংস ঘটনাও আছে।

র‌্যাবের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি ১৬৯১ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে আটক করে সংস্থাটি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮৯ জন, মার্চে ২৭৫ জন এবং এপ্রিলে ৭৫ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য আটক করা হয়। আর ২০২৩ সালে আটক করা হয় ৩৪৯ জন।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) লিটন কুমার সাহা বলেন, “কিশোর গ্যাং নাম হলেও তাদের মধ্যে যেমন ১৫, ১৬ বছর বয়সীরা আছে তেমনি, ২৫, ২৬ বছর বয়সীরাও আছে। তবে যে আঙ্গিকেই নামটি আসুক না কেন আমরা এটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। গত কয়েকদিনে ডিএমপি কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের মুভমেন্ট অনেকটা স্থগিত করতে পেরেছে। তবে শুধু আইনি প্রদক্ষেপ নিলেই হবে না, পরিবার ও সামাজিকভাবেও এটাকে প্রতিকার করতে হবে।”

লিটন কুমার সাহা বলেন, “তাদের যে কর্মতৎপরতা তা খুবই নৃশংস ধরনের। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান স্যারের নির্দেশে যেকোনো উপায়ে এটিকে বন্ধ করতে ডিএমপি কাজ করে যাচ্ছে। এই গ্যাংগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা কে করছে? তারা কেন এবং, কীভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে- এসব নিয়ে ডিএমপির ডিভিশনগুলো নিয়মিত মিনিটরিং করছে।”

 

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, “কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত আছে। র‌্যাবের প্রত্যেকটি ইউনিট এটি নিয়ে কাজ করছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত) ঢাকা টাইমসকে বলেন, “প্রতিটি বয়সেরই কিছু সৌন্দর্য আছে। আর কিশোর গ্যাং বলতে যেটা বোঝানো হয়, এই বয়সীদের বড় সৌন্দর্য হচ্ছে এরা খুব ক্রিয়েটিভ এডভেঞ্চারস। এই বয়সটাতে তারা শক্তি প্রদর্শন করতে চায় ও প্রয়োগ করতে চায়।”

 

ফারজানা রহমান বলেন, “আপনি যতক্ষণ তাদের ক্রিয়েটিভস করতে না পারবেন, সঠিকভাবে সুপারভাইস করতে না পারবেন, তাদের ভেতরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ বাড়বেই। এজন্য পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের মতে, কিশোররা কোনো অপরাধ করলে বেশিরভাগ সময়ে তাদের কিশোর সংশোধন বা উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। কিন্তু সেখানে কিশোরদের কাউন্সিলিংয়ের সুযোগ খুবই সীমিত। নামেমাত্র রিহ্যাবেলিটিস প্রোগামের মধ্যে রেখে আবার তাদেরকে সমাজে ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে নিজেদের ভুলগুলো তারা বুঝতে পারে না। ফলে বেশিরভাগ সময়েই কিশোররা সেখান থেকে ফিরে সেই আগের জীবনে ফিরে যায়।”

কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক বেশি জবাবদিহিতা রয়েছে বলে মনে করেন ফারাজানা রহমান। এই অপরাধবিজ্ঞানী বলেন, “অনেকসময় পলিটিক্যাল পার্টিগুলো প্রতিপক্ষকে হেনস্থা করতে টাকা, ড্রাগসসহ বিভিন্ন প্রলোভনে কিশোরদের ব্যবহার করে থাকে। এতে কিশোররা যখন দেখে এই কাজ থেকে প্রতিমাসে সহজেই ৩০-৪০ হাজার টাকা ইনকাম করা যায়, তখন তারা এই পথ থেকে বের হতে পারে না। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা না থাকলে এলাকাভিত্তিক যেসব গ্যাং বেড়ে যাচ্ছে তাদের নির্মূল করা সম্ভব না।”

রাজধানীতে অন্তত ৮০ কিশোর গ্যাং

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, শুধু রাজধানীতেই রয়েছে ৮০টির বেশি কিশোর গ্যাং। প্রতিটি গ্যাংয়ের সদস্যের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। এর মধ্যে জুয়েল বাহিনী, কামরুল বাহিনী, অতুল বাহিনী, শাহিন শরীফ, গাংচিল বাহিনী, ভাস্কর বাহিনী, রুবেল বাহিনী, অনিক বাহিনী, পাটালি গ্রুপ, রাকিব গ্রুপ, মাউরা গ্রুপ, এলেক্স গ্রুপ, আর্মি আলমগীর ও নবী গ্রুপ, ডাইল্লা গ্রুপ, আনোয়ার গ্যাং, সাইফুলের গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, বাবু রাজন গ্যাং, রিপন গ্যাং, মোবারক গ্যাং, নয়ন গ্যাং, তালাচাবি গ্যাং, নাইন এমএম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, স্টার বন্ড গ্রুপ, মোল্লা রাব্বির গ্রুপ, গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, ল ঠেলা গ্রুপ, আশরাফ গ্রুপ, কোপাইয়া দে, শাহীন-রিপন গ্যাং, নাজিম উদ্দিন গ্যাং, শা গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, সোলেমান গ্যাং, রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং, বাংলা ও লাভলেট গ্যাং, জুম্মন গ্যাং, চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিউম টু, ভাণ্ডারি গ্যাং, টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গাল গ্যাং, লাগবি নাকি, মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, বিহারি রাসেল গ্যাং, বিচ্ছু বাহিনী, পিচ্চি বাবু, কবজি কাটা গ্রুপ, রাব্বি-বাতেন-রাকিব গ্রুপ অন্যতম।

গত ২৭ এপ্রিল ‘কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলন নিয়ে ছায়া সংসদ’ অনুষ্ঠানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান জানান, ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি।

এ সময় হাবিবুর রহমান জানান, কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা যারা রয়েছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রয়েছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। যারা মদদদাতা গডফাদার তারা ওইভাবে গডফাদার নয়। তারা যে কিশোর অপরাধের জন্য গ্যাং তৈরি করেছে বিষয়টি এমন নয়। রাজনৈতিকভাবে কিছু লোক কিশোরদের নিয়ে যাচ্ছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

কিশোর অপরাধ নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো গাফিলতি নেই। অভিযোগ এলেই সঙ্গে সঙ্গে মামলা গ্রহণ করা হয় এবং জড়িতদের আইনের আওতায় এনে আদালতে সোপর্দ করা হয়। পরে কিশোর সংশোধানারে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রাথমিকভাবে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ পুলিশের কাজ নয়। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় জনসাধারণের কাজ। জনগণ সোচ্চার হলে কিশোর গ্যাং কালচার কমে যাবে।”

এর আগে এপ্রিলে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও আলোচনায় উঠে এসেছিল কিশোর গ্যাং ইস্যুটি। ওই বৈঠকে এসব গ্যাং নিয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

ওই বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “কিশোর অপরাধীদের সংশোধনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন সরকার প্রধান।”