২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে অনিশ্চয়তা
স্টাফ রিপোর্টারঃ
২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। এই লক্ষ্য পূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কতো তা এখনও চূড়ান্ত করা যায়নি। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে চিরতরে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের পরিকল্পনা থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি। ২০২২ সালের মার্চে দেশে করোনার আবির্ভাব ঘটলে এ কাজ আর সেভাবে এগোয়নি। দেশে বর্তমানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কতো তা নির্ধারণে এখনও কাজ করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনে অনিশ্চয়তা রয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও শিশুকে কোনও কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সরকারি আইনে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে এটি অমান্য করেই চলছে এ ধরনের নিয়োগ। এখনও দেশের বহু বাসাবাড়িতে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা কাজ করছে। কাজ করছে হোটেল রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে। এ ধরনের শ্রম বন্ধে সরকার নিতে পারছে না কোনও কার্যকর উদ্যোগ।
বাংলাদেশ কাউন্সিল ও লেবার রাইটস সাংবাদিক ফোরাম (আইটিইউসি) সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ দেশে শিশু শ্রমে নিয়োজিতের সংখ্যা ৪৭ লাখের বেশি। যে খাতগুলোতে শিশুশ্রম রয়েছে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট করে পদক্ষেপ নেওয়া গেলে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আগে দেশে শিশু শ্রমের যে অবস্থা ছিল, তা এখন অনেক কমেছে। তারপরও বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৪৭ লাখ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে কর্মরত শিশুর সংখ্যা সাড়ে ৩৪ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট হুমকিস্বরূপ। ২০১৩ সালে তৈরি করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় এমন তথ্য পাওয়া গেলেও ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সমীক্ষাটি চূড়ান্ত করে বিবিএস। বিবিএস এ বিষয়টি আপডেট করতে শিশুশ্রমিক জরিপ করছে বলে জানিয়েছেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহানা জামান।
তিনি জানিয়েছেন, দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা হালনাগাদ করার কাজ করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস। অল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো আমরা এ বিষয়ে একটি আপডেট তথ্য পাবো।
এদিকে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে শিশুশ্রম নিরসনে ৯ ক্ষেত্র চিহ্নিত করে দায়িত্ব বণ্টন করে ৯টি কৌশলগত ক্ষেত্র চিহ্নিত করে ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। ২০১০ সালের জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতির আলোকে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় ওই ৯টি কৌশলগত ক্ষেত্র চিহ্নিত করে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। সেই অনুসারে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে নীতি বাস্তবায়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের বিষয়টি দেখবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ন্যাশনাল কমিশন টু রিভিউ দ্য ওয়ার্কিং অফ দ্য কনস্টিটিউশন। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি দেখবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়নে কাজ করবে।
শিশুশ্রম রোধে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে তথ্য মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন। কর্মসংস্থান ও শ্রম বাজারে শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়টি দেখবে শ্রম মন্ত্রণালয়। আইন ও প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, শ্রম মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়। শিশুশ্রম প্রতিরোধে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগ কাজ করবে। শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্ব থাকবে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনগুলোর ওপর। এছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং সরকারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলো গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কাজ করবে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহানা জামান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শেকে শিশুদের সরিয়ে আনতে কীভাবে পুনর্বাসন করা যায় সে নিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি কাজ করছে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যেই কমিটি তাদের কাজ শেষ করবে। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশুশ্রম বন্ধে বিদ্যমান আইনের পর্যালোচনা ও সংশোধন প্রয়োজন। তারা জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মকৌশলে শিশুশ্রমকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তারা বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশু শ্রমিক কমবে না, বন্ধ হবে না শিশুশ্রম। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫ অনুসারে ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ করা যাবে না। শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে তারা মনে করেন। সঠিক সমন্বয় থাকলে শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ অনেকটাই বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল বলেও তারা মনে করেন।
উল্লেখ্য, কর্মরত শিশু, শিশুশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের আলাদা আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। ১৮তম শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনও শিশু যদি কোনও ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। তারাও কর্মরত শিশুর সংজ্ঞায় পড়ে। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কতো তা নির্ধারণে কাজ করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এসব শিশুর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে কীভাবে সরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসন করা যায় সে নিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়াও শিশুশ্রম নিরুৎসাহিত করতে সরকার স্কুলগামী শিশুদের নগদ অর্থ, খাবারসহ নানা ধরনের সুবিধা দিচ্ছে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধে শতভাগ সফলতা আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।