অগ্নিগর্ভ লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া সেই ইউএনও কেমন আছেন?
মোঃ ইসমাইল, বিশেষ প্রতিনিধিঃ স্মৃতি এখন ভুলে থাকতে চান তিনি। কী যে ভয়াবহ ছিল সেই রাত! অগ্নিগর্ভ লঞ্চ, চারদিকে আগুন। প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রীকে নিয়ে ঝাঁপ দিলেন নদীতে। পড়লেন গিয়ে কার্নিশে। পা ভেঙে যায় স্ত্রীর। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর রাতে সুগন্ধা নদীতে জ্বলন্ত লঞ্চে এমনই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও)।
সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ‘এমভি অভিযান-১০’ লঞ্চটিতে আগুন লাগে রাত তিনটার দিকে। তখন লঞ্চটি ছিল ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে। আগুন লাগার খবর জানানো হয় মালিক হামজালাল শেখকে। তিনি লঞ্চটি চালিয়ে যেতে বলেন। এরই মধ্যে ভয়াবহ আগুন লঞ্চের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
নোঙর না করেই লঞ্চ থেকে নেমে পড়েন সেখানে কর্মরত মাস্টার, ড্রাইভারসহ ২৬ কর্মচারী। জ্বলতে থাকা লঞ্চটি ঢেউ ও স্রোতের তোড়ে মাঝনদী দিয়ে চলতে থাকে ঘণ্টাখানেক। এরপর গিয়ে এক চরে আটকা পড়ে।
পরে জানা গেছে লঞ্চের ইঞ্জিন সমস্যা থেকে আগুনের সূত্রপাত। লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে উঠে আসে আগুন, ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। ঝালকাঠির পোনাবালিয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় সুগন্ধা নদীতে পুড়ে-ডুবে প্রাণ যায় ৪৭ জনের। দগ্ধ ও আহত হন অনেকে। লঞ্চটিতে কতজন যাত্রী ছিল, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বলছে, লঞ্চটিতে অন্তত ৪০০ যাত্রী ছিল। কিন্তু লঞ্চে থাকা যাত্রীদের অনেকের দাবি, নৌযানটিতে যাত্রী ছিল ৮০০ থেকে এক হাজার।
তাদেরই একজন পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ। সেদিন লঞ্চে তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী উম্মুল ওয়ারা। তারা লঞ্চটির ভিআইপি কেবিনের নীলগিরির যাত্রী ছিলেন। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও ডান পা ভেঙে যায় ইউএনও-পত্মী উম্মুল ওয়ারার। আর সঙ্গী হয় ভয়াবহ ট্রমা।
এখন কেমন আছেন ইউএনও হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ এবং তার স্ত্রী? গতকাল ঢাকা টাইমসকে ইউএনও বলেন, ‘আমরা এখন সুস্থ আছি। তবে সে রাতের স্মৃতি আর মনে করতে চাই না। সেই স্মৃতি ভুলে থাকতে চাই। কী যে ভয়াবহতা ছিল সেই রাত, তা বলে বোঝানো যাবে না। নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার পর আমার স্ত্রীর পা ভেঙে গিয়েছিল। ভর্তি করা হয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। প্লাস্টার করার পর হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়। বর্তমানে তিনি পুরোপুরি সুস্থ আছেন।’
মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয়ের মধ্যেও হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ দুর্ঘটনার দিন থেকেই অফিস শুরু করেন। আজ পর্যন্ত এক দিনও মিস করেননি বলে জানান তিনি।
সেদিনে যাত্রার কথা স্মরণ করে ইউএনও বলেন, ‘ঢাকা থেকে অফিশিয়াল কাজ সেরে ঘটনার দিন সন্ধ্যা ছয়টায় সস্ত্রীক লঞ্চে বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করি। রাত তিনটার দিকে লঞ্চে অন্য যাত্রীদের চিৎকারে ঘুম ভাঙে যায়। তখন দেখি চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। তড়িঘড়ি রুম থেকে বের হয়ে লঞ্চের সামনে গিয়ে দেখি কয়েক শ লোকের ভিড়। বেশির ভাগই বৃদ্ধ ও শিশু। লঞ্চ থেকে অনেক নারী নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তাদের দেখাদেখি তৃতীয় তলা থেকে লাফ দিলে দোতলায় পড়ে আমার স্ত্রী উম্মুল ওয়ারার পা ভেঙে যায়। এরপর স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে।’
ভালো কাজে প্রশংসিত আল মুজাহিদ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ৩১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে মেধা তালিকায় ৬৮তম স্থান অর্জন করেন আল মুজাহিদ। তার বাড়ি জামালপুরে। জামালপুর জিলা স্কুল থেকে এএসসি এবং সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি।
চাকরিজীবনে প্রথম যোগদান করেন বান্দরবানে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে চাকরি করেন। কাজের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে বিপুল প্রশংসা কুড়ান। মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ পরবর্তীতে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ইন্দুরকানীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসার হিসেবে যোগ দেন।
গত বছরের ৭ নভেম্বর পাথরঘাটার ইউএনও হিসেবে যোগ দেন হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ। সেখানে ইউএনও থাকাকালীন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুনাম কুড়ান। সেখান থেকে বদলি করা হলে তা ঠেকাতে স্থানীয় বাসিন্দারা মানববন্ধন করেন। এমনকি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিস কক্ষ পর্যন্ত ঘেরাও করা হয়। এ সময় অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আল মুজাহিদ ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ইন্দুরকানীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে যোগদান করার পর থেকে উপজেলাটি একটি মডেল উপজেলা হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেন।
করোনাভাইরাসের শুরুর দিকে ইন্দুরকানীতে করোনা রোগী সন্দেহে এক ভবঘুরে যুবককে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে নিজ গাড়িতে হাসপাতালে নিয়ে প্রশংসা কুড়ান তিনি। দুই দিন ধরে জ্বর, সর্দি-কাশি নিয়ে জঙ্গলে পড়ে ছিল ওই যুবক।
এ ছাড়া ইন্দুরকানী উপজেলার চন্ডিপুরের শ্যামলী নিসর্গ ম্যাগ্রোভ ফরেস্টের মনোরম পরিবেশে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা, অসহায় মানুষদের বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পান। নিষ্কন্টকভাবে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে ঘর বিতরণের মধ্য দিয়েও সুনাম অর্জন করেন তিনি।