জিবিএসে ভুগে মারা যান ফারুক! কতটা ভয়ানক এ রোগ? জানুন বিস্তারিত

ভোলার কথা
বিশেষ প্রতিনিধিঃ সম্পাদক
প্রকাশিত: ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, মে ১৬, ২০২৪

বিশেষ প্রতিনিধিঃ

চিত্রনায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুর এক বছর হয়ে গেল। গত বছরের ১৫ মে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ছাড়েন। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, গুলের-বারি সিনড্রোম বা জিবিএস নামে রোগে ভুগছিলেন।

চিকিৎসকদের ভাষ্য মতে, জিবিএস হলো এক বিরল নিউরোলজিক্যাল রোগ। টানা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা করাচ্ছিলেন ফারুক। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

কিন্তু কতটা ভয়ংকর এই রোগ? লক্ষণ এবং চিকিৎসাই বা কী? চলুন জেনে আসি বিস্তারিত।

জিবিএস নামে বিরল এই নিউরোলজিক্যাল রোগটি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভুলভাবে তার পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রের অংশ, মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের বাইরে অবস্থিত স্নায়ুর নানা অংশকে আক্রমণ করে। এটি একদিকে সংক্ষিপ্ত দুর্বলতাসহ খুব খারাপ পক্ষাঘাতের মত অবস্থা তৈরি করতে পারে। এর ফলে ব্যক্তি স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে পারে না।

সৌভাগ্যবশত, বেশিরভাগ সময়েই আক্রান্ত রোগী জিবিএসের সবচেয়ে গুরুতর অবস্থা থেকেও পরিত্রান পান। তবে পরিত্রানের পরেও অনেকের মাঝে দুর্বলতা থেকে যায় দীর্ঘসময়। জিবিএস যে কারও ক্ষেত্রেই হতে পারে। সুনির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই যে শুধু প্রাপ্ত বয়স্কদেরই হবে বা ছোটদের হবে না। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এর হার বেশি।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর এক লাখ মানুষের মধ্যে একজনের জিবিএসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এটি দেশের বাইরের পরিসংখ্যান, আমাদের দেশের সঠিক তথ্য এখন পর্যন্ত নেই।

যে কারণে এ রোগের উৎপত্তি

কী কারনে জিবিএস হয় তা সঠিকভাবে জানা যায়নি এখনো। গবেষকরা সঠিকভাবে জানেন না, কেন এই রোগটি কিছু লোককে আঘাত করে এবং অন্যদের নয়। এটি সংক্রামক বা উত্তরাধিকারী সূত্রে হয় না। অর্থাৎ, পরিবারের কারও হলে অন্যদের হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

গবেষকরা বের করেছেন যে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটির ইমিউন সিস্টেম শরীরের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তাই জিবিএসকে অটোইমিউন রোগ বলা হয়। সাধারণত ইমিউন সিস্টেম সংক্রামক, ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। জিবিএস সেই প্রতিরক্ষা সিস্টেম ও সুস্থ স্নায়ুকে মারাত্মকভাবে আক্রমণ করে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্বাসযন্ত্র বা পাকস্থলী ও খাদ্যনালীতে ভাইরাল সংক্রমণের পরে সাধারণত কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ পর এ রোগ শুরু হয়। মাঝে মাঝে অপারেশন করার কারণেও এটি হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিরল ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনও জিবিএসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

জিবিএস রোগের লক্ষণ

লক্ষণ হিসাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাত বা পায়ের অনুভূতি বা সঞ্চালন ক্ষমতা হ্রাস পায়। শিশুর হাঁটায় অসুবিধা হয় এবং হাঁটতে চায় না। শরীরের উভয় পাশে দুর্বলতা একটি প্রধান উপসর্গ। দুর্বলতায় প্রথমে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বা হাঁটায় অসুবিধা হয়। লক্ষণগুলো প্রায়ই অস্ত্র, শ্বাস পেশী এবং এমনকি মুখকে প্রভাবিত করে, যা আরও ব্যাপকভাবে স্নায়ুর ক্ষতি করে।

উপসর্গগুলো আবির্ভূত হওয়ার প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে অধিকাংশ লোক দুর্বলতার সর্বাধিক পর্যায়ে পৌঁছায়। তৃতীয় সপ্তাহে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতির লক্ষণ দেখা যায়। তাই যেসব লক্ষণ দেখলেই সতর্ক হবেন-

পেশীর দুর্বলতা, চোখের পেশীর ক্ষতি এবং দেখতে কষ্ট হওয়া, কথা বলা বা খাবার চিবানোর সমস্যা হওয়া, হাত বা পায়ের অনুভূতি কমে যাওয়া, ব্যথা- বিশেষ করে রাতে গুরুতর হতে পারে, হার্ট বিট বা রক্তচাপের অস্বাভাবিকতা এবং প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হওয়া।

এই উপসর্গগুলো দিন অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে তীব্রভাবে বাড়তে পারে, যতক্ষণ না নির্দিষ্ট পেশীগুলি কখনোই ব্যবহার করা যায় না এবং যখন গুরুতর হয়, তখন সেটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে, ব্যাধিটি হলো প্রাণঘাতী।

জিবিএসর চিকিৎসা কোথায় কীভাবে করা হয়?

এ রোগের জন্য পরিচিত কোনো প্রতিকার নেই। তবে কিছু থেরাপি অসুস্থতা কমিয়ে এবং পুনরুদ্ধারের সময় হ্রাস করতে পারে। এছাড়া রোগের জটিলতা মোকাবেলার বিভিন্ন উপায় রয়েছে।

ইমিউনোগ্লবিউলিন ইঞ্জেকশান, প্লাজমা একচেঞ্জের মাধ্যমে রোগের জটিলতা কমানো বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় বেশিরভাগ সময়ে। আমাদের দেশে দুটিই চালু রয়েছে। এর মাঝে ইমিউনোগ্লবিউলিন ইঞ্জেকশান রোগীর ওজন অনুযায়ী দেয়া লাগে বলে এর খরচ অনেকের জন্য অনেকটাই ব্যয়বহুল।

প্লাজমা এক্সচেঞ্জের চিকিৎসায় জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি বেশিরভাগের জন্যই নাগালের ভেতরের চিকিৎসা। উপরন্তু সরকারিভাবে এই সেবা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে ঢাকার বেশ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে।

চিকিৎসার একটি বড় অংশ হলো ফিজিওথেরাপি। সেটি শ্বাসযন্ত্রের ক্ষেত্রেও যেমন কার্যকর তেমনি শরীরের অন্য অংশের মাংসপেশির জন্যও কার্যকর। আমাদের সবার জানা থাকা উচিত, এটি কোনো সংক্রামক রোগ নয়। সচেতনতা থাকলে এই রোগের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ।