বিলুপ্তির পথে নানা নৌকা

ভোলার কথা
নিউজ ডেস্ক সম্পাদক
প্রকাশিত: ৪:৩১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২, ২০২৪

নিউজ ডেস্কঃ

নৌকা পৃথিবীর অনেক দেশে ক্রীড়া ও প্রমোদের জন্য ব্যবহূত হলেও নদীমাতৃক বাংলাদেশে ইহা যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া পণ্য পরিবহণ ও জেলেদের মাছ ধরার কাজেও নৌকার ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্ষাকালে এর প্রচুর ব্যবহার হয়। নৌকার চালককে বলা হয় মাঝি। নৌকার বিভিন্ন অংশ হলো- খোল, পাটা, ছই বা ছাউনি, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্ত্তল, নোঙর, খুঁটি দুড়, গলুই, বৈঠা, লগি ও গুণ। নৌকা প্রধানত কাঠ দিয়ে তৈরি। মাছ ধরার ডিঙ্গি আকারে ছোট, আবার পণ্য পরিবহণের নৌকা আকারে বেশ বড়। ছই বা ছাউনি তৈরিতে বাঁশ বব্যহার করা হয়। খোলকে জলনিরোধ করার জন্য আলকাতরা ব্যবহার করা হয়। লগি তৈরি হয় বাঁশ থেকে। পাল তৈরি হয় শক্ত কাপড় জোড়া দিয়ে। গঠনশৈলী ও পরিবহণের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন রয়েছে, যেমন: ছিপ, বজরা, ময়ুরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান, ভেলা ও কলার ভেলা। বিশ শতকের নববইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশে নৌকায় মোটর লাগানো শুরু হয়। এর ফলে নৌকা একটি যান্ত্রিক নৌযানে পরিণত হয়। এই যান্ত্রিক নৌকাগুলি শ্যালো নৌকা নামে পরিচিতি লাভ করে। পানি সেচের জন্য ব্যবহূত শ্যালো পাম্পের মোটর দিয়ে এবং স্থানীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব নৌকা চালানোর ব্যবস্থা করা হয়।

ডিঙ্গি নৌকা বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের নৌকার মধ্যে সাম্পান সবচেয়ে পরিচিত। এদেশের লোকগীতি ও সাহিত্যে এই সাম্পানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায় সাম্পান। চট্টগ্রাম, কুতুবদিয়া এলাকায় সাম্পান নৌকা বেশি দেখা যায়। এই নৌকাগুলির সামনের দিকটা উঁচু আর বাঁকানো, পিছনটা থাকে সোজা। প্রয়োজনে এর সঙ্গে পাল থাকে আবার কখনও থাকে না। এক মাঝিচালিত এই নৌকাটি মাল পরিবহণের জন্য ব্যবহূত হয়। এটি লম্বায় হয় ৫.৪০-৬.১০ মিটার এবং চওড়ায় হয় ১.৪০-১.৫৫ মিটার পর্যন্ত। এক সময় বড় আকারের সাম্পানও দেখা যেত কুতুবদিয়া অঞ্চলে, তবে এখন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই সাম্পানগুলির দৈর্ঘ্য ১২.৮০ থেকে ১৪.৬৫ মিটার পর্যন্ত হতো এবং প্রস্থ ছিলো ৪.৬০ থেকে ৫.২০ মিটার। সাতজন মাঝি থাকতো আর থাকতো তিনকোণা আকারের তিনটি করে পাল।

গয়না নৌকা আকৃতিতে মাঝারি ধরনের, দৈর্ঘ্যে ৭.৬০-১২.৮০ মিটার এবং প্রস্থে হতো ১.৮০-৩ মিটার পর্যন্ত। এই ধরনের নৌকা কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে বেশি দেখা যেত। মূলত যাত্রী পারাপারের কাজেই এদের ব্যবহার করা হতো। একসাথে প্রায় ২৫-৩০ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করার ক্ষমতা ছিল এই নৌকাটির। আবার রাজশাহী অঞ্চলে এর থেকেও বড় আকারের গয়না নৌকা পাওয়া যেত। এদের দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ১৪.৬০-১৮.২০ মিটার। এরা আকারে যেমন বড় তেমনি এই নৌকায় বেশি সংখ্যক যাত্রীও উঠতে পারতো। বর্তমানে এই নৌকাও বিলুপ্তির পথে।

আগের দিনে ধনী লোকেরা শখ করে নৌকা ভ্রমণে যেতেন। তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল বজরা নৌকা। বজরাতে তারা এক রকম ঘরবাড়ি বানিয়ে নিতেন। ফলে এতে খাবারদাবারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই থাকতো। কোনটিতে আবার পালও থাকতো। এতে থাকতো চারজন করে মাঝি। এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ থেকে ১৪.৬৫ মিটার পর্যন্ত আর প্রস্থ ২.২৫ থেকে ৩.২০ মিটার পর্যন্ত। বজরা মূলত সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলে দেখা যেত।

নৌকা বাংলাদেশে এতটাই জীবনঘনিষ্ঠ ছিলো যে এই নৌকাকে ঘিরে হতো অনেক মজার মজার খেলা। নৌকা বাইচ এখনও একটি জনপ্রিয় খেলা। বাইচের নৌকা লম্বায় ১৫০-২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। প্রতিযোগিতার সময় এতে ২৫ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত মাঝি থাকতে পারে। আগে নবাব-বাদশাহরা বাইচের আয়োজন করতেন। এইসব বাইচের নৌকার সুন্দর সুন্দর নাম দেওয়া হতো যেমন: পঙ্খীরাজ, ঝড়ের পাখি, দ্বীপরাজ, সোনার তরী প্রভৃতি। কিশোরগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা ইত্যাদি অঞ্চলে এসব নৌকা ছিল।

বিভিন্ন ধরনের নৌকা
পাশাপশি দুটো নৌকা জোড়া লাগিয়ে যে নৌকা বানানো হয় সেটি আসলে মালবাহি নৌকা। এগুলি লম্বায় প্রায় ১৩.৭০-১৬.৭৫ মিটার হয়ে থাকে এবং চওড়ায় থাকে ৫.৫০-৬.১০ মিটার পর্যন্ত। এই নৌকায় মাঝি থাকে ৫-৬ জন।

রাজা বাদশাহদের সৌখিন নৌকার নাম হলো ময়ূরপঙ্খী। এর সামনের দিকটা দেখতে ময়ূরের মতো বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে ময়ূরপঙ্খী। এই নৌকাগুলি দৈর্ঘ্যে ১১.৪০-১৩.৭৫ মিটার পর্যন্ত এবং প্রস্থে ২.৭৫-৩ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই নৌকা চালাতে প্রয়োজন হয় চার জন মাঝির। এই নৌকায় থাকতো দুটো করে পাল।

বরিশাল অঞ্চলের নদীতে মাঝারি আকারের এক ধরনের মাছ ধরার নৌকা দেখা যায়। এগুলির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭.৩৯-৯.১০ মিটার হয়। এতে ৩/৪ জন মাঝি বা জেলে থাকে। আবার চাঁদপুরে আরেক ধরনের মাছ ধরার নৌকা দেখা যায়। এগুলির দৈর্ঘ্য ৯.১৫-১১.৪৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এতে মাঝি থাকে ৮-১০ জন করে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় আকারের মাছ ধরার নৌকার দৈর্ঘ্য ১৫.২৫-১৮.৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত নৌকার নাম হচ্ছে ডিঙ্গি। নদীর তীরে যারা বাস করেন তারা সকলেই এই নৌকাটি ব্যবহার করেন নদী পারাপার বা অন্যান্য কাজে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়।

কুষ্টিয়া অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও নৌকা ব্যবহূত হয়ে আসছে। সেখানে বিখ্যাত নৌকার নাম হলো বালার। এই নৌকাগুলি আকারে অনেক বড় হয় এবং প্রায় ১২-৫৬ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। এরা দৈর্ঘ্যে ১২-১৮ মিটার হয়ে থাকে আর বৈঠা বায় ১০-১২ জন মাঝি। এই ধরনের নৌকায় পাল থাকে দুটো করে।

বালারের মতো খুলনা অঞ্চলে ব্যবহূত নৌকা বাতনাই বা পদি নামে পরিচিত। এই নৌকাগুলি চালাতে ১৭-১৮ জন মাঝি লাগতো। এইগুলি প্রায় ১৫.২৫-২১.৩৫ মিটার পর্যন্ত লম্বায় থাকতো। এতে করে ১৪০-১৬০ টন মাল বহন করা যেত। এই ধরনের নৌকায় থাকতো বিশাল আকারের চারকোণা একটি পাল। কিন্তু এই ধরনের নৌকা এখন আর বাংলাদেশের কোথাও দেখা যায় না।