দয়া-দাক্ষিণ্য নয় জনগণকে সেবাদান- রাষ্ট্রপতি
স্টাফ রিপোর্টারঃ জনগণকে সেবাদান কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য বা বদান্যতার বিষয় নয় উল্লেখ করে বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘মনে রাখতে হবে জনগণের টাকায়ই আমাদের সংসার চলে। তাই সেবা পাওয়াটা জনগণের অধিকার।’ এ সময় তিনি মাঠ প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তোলার নির্দেশ দেন।
আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী বার্ষিক ডিসি সম্মেলন- ২০২২ অনুষ্ঠানে তিনি এই নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবন থেকে ভার্চুয়ালি সম্মেলনে যোগ দেন। করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর ডিসি সম্মেলন হয়নি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দুর্নীতি উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। দুর্নীতির কারণে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই মাঠ প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।’
আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিটি স্তরে দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করা হয় উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, দায়িত্ব সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ অত্যাবশ্যক, কিন্তু ক্ষমতার যাতে অপপ্রয়োগ না হয় তা নিশ্চিত করা আরও বেশি জরুরি।
রাষ্ট্রপ্রধান কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব ও ক্ষমতার পার্থক্য সচেতনভাবে বজায় রাখার ও তাগিদ দেন।
জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে হামিদ বলেন, মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনে বিরাজমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং নাগরিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনার জন্য জেলা প্রশাসক সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। তিনি বলেন, ‘আপনারা মাঠ পর্যায়ে সরকারের বিভিন্নমুখী কার্যক্রমের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’
রাষ্ট্রপতি জনগণের সেবক হিসেবে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘আমরা ও আপনারা জনগণের সেবক। তাই জনগণের সেবক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করবেন। জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেবেন।’
দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি একটি কার্যকর মাধ্যম বলে মনে করেন রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি বলেন, এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের দরিদ্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, সামাজিক সুরক্ষা এবং জনগণের বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ডিসিদের কার্যকর নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রকৃত দরিদ্ররা যেন এই কর্মসূচির সুফল ভোগ করতে পারে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের সচেষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব গ্রামোন্নয়নের দিকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে, যা বিগত বছরগুলো থেকে আলাদা। শহরের ন্যায় গ্রামগুলোতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মফস্বল এলাকাগুলোতে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ডিসিদের আবাসন, শিক্ষা, কৃষি নির্ভর শিল্পের প্রসার, চিকিৎসা সেবা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে উপজেলা সদর ও বর্ধিষ্ণু শিল্পকেন্দ্রগুলোকে আধুনিক শহর-উপশহর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে।
ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা খুব বেশি ও সরাসরি যা গ্রামীণ বিরোধ ও মামলা মোকদ্দমার অধিকাংশ জমিজমা সংক্রান্ত উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সরকার দক্ষ, আধুনিক, জনকল্যাণমুখী ও টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং ভূমি সংক্রান্ত জনবান্ধব সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জনগণকে ভূমি বিষয়ক সেবা প্রদানের জন্য ডিজিটালি কাজ করে যাচ্ছে।’
রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, কিন্তু ভূমি রেকর্ডের সময় এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারী স্থানীয় প্রভাবশালী দালাল চক্রের সহযোগিতায় অনেক অনিয়ম করছে এবং অবৈধ সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে জনভোগান্তি বেড়েছে। তাই তিনি এসব ব্যাপারে ডিসিদের কঠোর হতে আদেশ দেন এবং যেকোনো অনিয়ম বন্ধ করতে শক্ত পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেন।
রাষ্ট্রপতি সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করার আদেশ দেন।
তিনি বলেন, সরকার তথ্য অধিকার আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে, সরকারি তথ্য ও সেবা নাগরিকের জন্য সহজলভ্য করার লক্ষ্যে জেলা ই-সার্ভিস সেন্টার, পৌর ডিজিটাল সেন্টার ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করেছে।
এই সেবা কেন্দ্রগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে ডিসিদের জোরালো ভূমিকা রাখার এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেবাকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সামাজিক বনায়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন, জলাভূমির উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের চলমান কর্মসূচির বাস্তবায়নে তাদেরকে আরও সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেন।
রাষ্ট্রপ্রধান দেশের উন্নয়ন সুষম ও জনমুখী করতে জেলা ও উপজেলা সদরে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে বন, নদী ও পাহাড় রক্ষা করতে কঠোর হওয়ার আদেশ দেন।
মাদকের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আব্দুল হামিদ বলেন, মাদকদ্রব্য যাতে দেশের প্রাণশক্তি যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে না দেয় সে দিকেও ডিসিদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, আমার বিশ্বাস, আপনাদের মেধা ও দক্ষতা জনকল্যাণের লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে যথাযথ অবদান রাখবে। আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে দেশাত্মবোধ ও একাগ্রতার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাবেন। তিনি বলেন, নবতর উদ্ভাবনী চর্চা ও সেবামূলক কর্মপ্রয়াসের দ্বারা আপনারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবেন – এটাই সকলের প্রত্যাশা।
আবদুল হামিদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে।
হামিদ বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ২০৩০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ এসডিজির সকল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে এবং ২০৪১ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।
তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় চার নেতা এবং অমর শহীদদের, যাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সূত্র: বাসস