৫২-র ভাষা আন্দোলনে ভোলার একমাত্র ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী (চুন্নুমিয়া)

ভোলার কথা
ভোলার কথা সম্পাদক
প্রকাশিত: ৭:৫৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১

 

মোঃ ইসমাইল, বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, সাগর-নদীর মোহনার কোল ঘেষে দ্বীপের রাণী ভোলা।

মানচিত্রের এ জেলাটি মেঘনা, তেতুলিয়া, এবং বঙ্গোপসাগর বেস্টিত। সাগর-নদী আর বেলা ভূমির মাটিতে এ জেলার মানুষের বসবাস। পলিমাটির জেলেদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও দৃষ্টি নন্দিত উপজেলা বোরহানউদ্দিন।

মগ, আরাকান, পর্তুগীজ ও বার্মিজ জলদস্যুদের হাত থেকে এ জেলার মানুষকে বীর সেনা শাহবাজ খান যেভাবে রক্ষা করেছেন ঠিক তেমনি পাকিস্তানি হায়নাদের হাত থেকে ভোলা বাসীকে রক্ষা করেছেন ভোলার বীর সন্তান রেজা-এ-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া)।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার সংগ্রামী নেতৃত্ব দেওয়া ভোলার সম্রান্ত, মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান রেজা-এ-করিম চৌধুরী (চুন্নু মিয়া) ১৯৩২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের আব্দুল জব্বার মিয়া বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫০ সালে বোরহানউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং বরিশাল ল-কলেজ থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করেন। কর্ম জীবনে তিনি ছিলেন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও আদর্শ শিক্ষক। বোরহানউদ্দিন মির্জাকালু হাইস্কুল, বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বোরহানউদ্দিন আব্দুল জব্বার কলেজে (বর্তমানে আব্দুল জব্বার সরকারি কলেজ) তিনি শিক্ষকতা করেন। বোরহানউদ্দিন উপজেলার প্রথম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আব্দুল জব্বার কলেজে’র প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
তার পিতা মজিবল হক চৌধুরী ১৯৫৪ পাকিস্তানি শাসনামলের যুক্তফ্রন্ট থেকে এমএলএ হয় ও পাকিস্তানি সংবিধানের প্রবর্তক সদস্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে রেজা-এ-করিম চৌধুরী মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে প্রগতিশীল ও আদর্শীক রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। ঢাকা কলেজে অধ্যায়নের সময় তিনি ভাষা আন্দোলন জড়িয়ে পড়েন এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সাথে একাত্নতা ঘোষনা করে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২-র ২১ ফেব্রয়ারীর আগের দিন ১৪৪ ধারা ভেঙে ৮/১০ জন ঢাকা কলেজের ছাত্রদের এক খন্ড মিছিল নিয়ে এসেম্বলি হলের কাছে এলে পুলিশী বাধার মুখে পড়ে। এসময় এ মিছিল থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। টানা একমাস জেল থাকার পর তাকে ছেড়ে দেয়। জেলে থাকা অবস্থায় তাকে সহ্য করতে হয় পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচার। ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী সাহেবের রাজনৈতিক পথ অতটা মসৃণ ছিলোনা। তাকে বারবার শাসকগোষ্ঠি দ্বারা নির্যাতিত হতে হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য ১৯৫৪ সালে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। তবুও স্বাধীকার ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুকে নিয়ে অংশগ্রহণ করা ৭০’এর নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে এমপিএ হিসেবে নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আমলে সংসদে রেজা-এ-করিম চৌধুরীর আনা সংশোধনী পাশ করতে বাধ্য হয়। তিনি ছিলেন ৭২’এর সংবিধান প্রণয়ন সদস্য। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রতিটি ধাপে তিনি সক্রিয় অংশ নেয়।
দ্বীপ জেলা ভোলার একমাত্র ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধেরও বীর সংগঠক। ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার নেতৃত্ব দেন ও ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোলাকে রাজাকার মুক্ত করেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় তিনি গনপরিষদের সদস্য (এমসিএ) নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তিনি বোরহানউদ্দিন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন বোরহানউদ্দীন উপজেলার বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর অবদানের জন্য তাকে ২০০০ সালে মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে বিজয় পদক সম্মানে ভূষিত করা হয়।
রেজা-এ-করিম চৌধুরী তার মেধা, শ্রম, সাহস, দেশপ্রেম, সততা ও জনসেবার মধ্য দিয়ে ভোলার মানুষের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন।

জনদরদী ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজা-এ-করিম চৌধুরী ২০০৭ সালের ২রা মার্চ পরোপারে চলে যান। তবে রেখে যান তার অমর স্মৃতিগুলো। জাতি আজও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছে ভোলার গর্বিত এই একমাত্র ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজা-এ-করিম চৌধুরীকে।