‘বৈষম্য -অসমতা ও দুর্বৃত্তায়নই দারিদ্র্যের প্রধান উৎস’

ভোলার কথা
ভোলার কথা সম্পাদক
প্রকাশিত: ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২১

 

লেখিকা-
সায়মা জাহান সরকার
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

দারিদ্র্য -বৈষম্য -অসমতার বিস্তৃতি,মাত্রা, গভীরতা ও তীব্রতা এখন যা এবং যেদিকে এগুচ্ছে, প্রবণতার চাকাটি যে তার উল্টো দিকে আনতে হবে -এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের যুক্তিসঙ্গত তেমন কোন কারণ নেই। আর সেটাই হবে আমাদের সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশের সর্বোৎকৃষ্ট নির্দেশক। স্বাধীনতার পরে বিশেষতঃ ১৯৭৫ পরবর্তী বিগত প্রায় ৪৯ বছরে আমাদের দেশে উত্তরোত্তর অধিক হারে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতার উৎপাদন ও পুনরুত্থান হয়েছে। দারিদ্র্যের উৎস-বৈষম্য ও অসমতার বিকাশ হয়েছে অবারিত। বৈষম্য সৃষ্টির উৎসসমূহে কি অর্থনীতি, কি রাজনীতি, কি শিক্ষা-সংস্কৃতি-সর্বত্র এক আত্মঘাতী লুণ্ঠন সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। এ লুণ্ঠনকারীরাই হলেন রেন্ট সিকার’স (Rent seekers)। যারা আসলে সম্পদ সৃষ্টি করেন না, তারা সরকার ও ক্ষমতার রাজনীতি ব্যবহার করে অন্যের সম্পদ হরণ করেন (বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড.আবুল বারাকাত তাঁর লোক বক্তৃতায়ও ‘Rent seeking’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন)।এ লুণ্ঠন সংস্কৃতির চরিত্র-নিয়ামক হল কালো টাকা, জবর দখল (ভূমিদস্যু, জলদস্যু, বনদস্যুর) সন্ত্রাস, পেশিশক্তি, ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারি অনিয়ম, অযৌক্তিক পৃষ্ঠপোষকতা, বিভিন্ন কোটা, উপহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদ-সম্পত্তির অপব্যবহার, একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি, কু-আইন, সু-আইন বাস্তবায়নে বাঁধা সৃষ্টি, কুশাসন-অপশাসন, দমন-নিপীড়ন, ইত্যাদি। পুঁজিবাদ বিকাশে লুন্ঠন নিয়ামক ভূমিকা পালন করে কিন্তু এদেশে উল্লেখিত আত্মঘাতী লুণ্ঠন প্রক্রিয়া জাতীয় পুঁজি বিকাশে ব্যর্থ হয়েছে -তা না হ’লে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী বন্ধ হবে কেন? কেন বন্ধ হয়েছে মৌলিক ভারী শিল্প? কেন পানির দামে রাষ্ট্রীয় উৎপাদনি প্রতিষ্ঠান বিক্রি হয়ে যায়? কেন বিরাষ্ট্রীয়করণকে সর্বরোগের নিরাময় বলা হয়? কারা এসব প্রেসক্রিপশন দেন? কেনইবা নির্বিচারে আমরা তাদের কথা শুনতে বাধ্য হই?
স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭৫ পরবর্তী অর্থনীতির হরিলুট বৈষম্য বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য-অসমতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করেছে এবং তা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদে পড়েছে এবং তা থেকে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা বিমোচিত হবেনা। কারণ বাস্তব অবস্থাটা আসলে বাজার-রাজনীতি-সরকারের সাথে দুর্বৃত্তদের এক অশুভ স্বার্থ -সম্মিলনের প্রতিফলন মাত্র। দুর্বৃত্তায়নের দৃশ্যমান বিষয়টি নিম্নরুপঃ
গত ৪৮/৪৯ বছরে সরকারিভাবে যে প্রায় ২.৫ লক্ষ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণে-অনুদান এসেছে, তার ৭৫ ভাগ লুণ্ঠন করেছে অর্থনীতি-রাজনীতির দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী। ফলে ক্ষমতাধররা অধিকতর ক্ষমতাবান হয়েছেন আর ক্ষমতাহীন দারিদ্র্যের অক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্বৃত্ত -লুটেরাদের সাথে বাজার-অর্থনীতি-রাজনীতি-সরকারের সমস্বার্থের সম্মিলনই এ অবস্থার স্রষ্টা। এ সমীকরণের বাইরে অন্যান্য অনেক উপাদানই বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবক হতে পারে তবে নিয়ামক নয়।
অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কার্যকরী চাহিদা বৃদ্ধি করেছে; আর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন অর্থনৈতিক।
দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদকে উত্তরোত্তর শক্তিশালী করছে।দুর্বৃত্তায়নের এ প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে এখন নবসংযোজন হয়েছে গণমাধ্যম দখলে। ক্ষমতাবানেরা এক ধরনের নিকৃষ্ট পুঁজির মালিক হয়েছেন। এ বিত্তের প্রধান উৎস ‘Rent seeking’। এ পুঁজি শুধু অনুৎপাদনই নয়, তা সৃষ্টও নয়, এ বিত্ত হরণকৃত।উৎপাদন শীল বিনিয়োগে এর তেমন আগ্রহ নেই।আর যদি থেকেও থাকে তাহলে শুধু সেক্ষেত্রে যেখানে আরও বেশি রেন্ট সিকিং হতে পারে অথবা রেন্ট সিকিং সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে সম্ভাব্য বিপত্তি এড়ানো যায়। ক্ষমতাবানেরা এখন কালো অর্থনীতির একটা বলয় সৃষ্টি করেছেন, যে দুষ্টচক্রে বছরে এখন ৭৫-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হয়,আর অর্থমন্ত্রনালয়ের হিসেবে জিডিপির ৪০-৮৫ শতাংশের সমপরিমাণ হবে কালো টাকার পরিমাণ অর্থাৎ মোট ৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত।এ বলয়ে যাদের অবস্থান, তারাই আবার ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপী। এরাই বছরে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত। এরাই বছরে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকার সমপরিমাণ মুদ্রা পাচার করে,এরাই অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি করেছেন যেখানে দারিদ্র্য বিমোচন অসম্ভব প্রায়।এরাই আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে এবং অথবা তাকে ব্যবহার করে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকান্ড দুরুহ করেছেন।এরাই সৃষ্টি -পুনঃসৃষ্টি করছেন ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও অসমতা। দেখা গেছে দুর্বৃত্ত -বেষ্টিত সরকার তার বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে যত না মানুষকে গুরুত্ব দিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছেন লুণ্ঠনের খাতকে। যে পরিমাণ অর্থ সম্পদ বিনিয়োগ করে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরুপে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ মুক্ত করা সম্ভব, তার সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে অপ্রয়োজনীয় অনেক খাতে। বাজেট ঘাটতি হবে অথচ অনুৎপাদনশীল ব্যয় উদ্বৃত্ত হবে। এ ধরনের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত আর যাই হোক দারিদ্র্য বিমোচন উদ্দিষ্ট নয়। এখানেও ক্রমবর্ধমান অসমতা সৃষ্টির রাজনৈতিক অর্থনীতি দৃশ্যমান। ক্ষমতাবান দুর্বৃত্তদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে যা উত্তরোত্তর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট দারিদ্র্য-বৈষম্য বৃদ্ধি করছে যার সবগুলোই সংবিধানের ১১, ২৬-২৯, ৩১-৩২, ৩৫-৪১, ৪৩-৪৬ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এসবের পুঞ্জীভূত রুপটি এমন-যেখানে নির্বাচন মানেই বড় মাপের আর্থিক বিনিয়োগ এবং কালোটাকার প্রতিযোগিতা; যেখানে সন্ত্রাস-সহিংসতা অনিবার্য ও নৈমিত্তিক বিষয়; যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমাননা সাধারণ নিয়ম; যেখানে সরকারি গণমাধ্যম মানেই স্তুতি প্রচারের যন্ত্র, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ বিষয়টি নেহাতই স্লোগান; যেখানে সুশাসন বিষয়টি অতিমাত্রায় উচ্চারিত কিন্তু প্রকৃতই মূল্যহীন; যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেহাতই কাগজ; যেখানে মানুষের দুর্দশা -বঞ্চনাকেন্দ্রিক ব্যবসা সবচেয়ে লাভজনক;যেখানে গরীব-নিম্নবিত্ত মানুষ অন্যায় দেখলেও নীরবে সহ্য করার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাহীন মানুষ অতিকষ্টে জীবন-যাপন করছেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দেশের মোট জাতীয় আয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হিস্যা উত্তরোত্তর কমেছে আর ধনীদের বেড়েছে, ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের একথা সরকারিভাবেই স্বীকৃত। আসলে এ পথ উত্তরণের উপায় কী?আমরা কী পারবো এ বৈষম্য কমিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে? আমাদের সম্মুখে সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।